জীবপ্রযুক্তিঃ
কোলম্যান (১৯৬৮) এর মতে, জীবন্ত উদ্ভিদ, প্রাণী, অণুজীব বা এদের অংশবিশেষ ব্যবহার করে মানবতার কল্যাণে ব্যবহারোপযোগী উন্নত বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন নতুন উদ্ভিদ, প্রাণী, অণুজীব বা দ্রব্য উৎপাদনে প্রয়োগকৃত প্রযুক্তি হলো জীবপ্রযুক্তি।
টিস্যু কালচারঃ
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ও রিকম্বিনেন্ট DNA প্রযুক্তি
উদ্ভিদ টিস্যু কালচার (Plant tissue culture)
উদ্ভিদের যেকোনো বিভাজনক্ষম অঙ্গ থেকে (যেমন-শীর্ষমুকুল, কক্ষমুকুল, কচি পাতা বা পাপড়ি ইত্যাদি) বিচ্ছিন্ন করা কোনো টিস্যু সম্পূর্ণ জীবাণুমুক্ত (sterile) অবস্থায় উপযুক্ত পুষ্টি মাধ্যমে বৃদ্ধিকরণ (এবং পূর্ণাঙ্গ চারাউদ্ভিদ সৃষ্টি) করাকে টিস্যু কালচার বলে। অর্থাৎ গবেষণাগারে কোনো টিস্যুকে পুষ্টি মাধ্যমে কালচার করাই হলো টিস্যু কালচার।
টিস্যু কালচার প্রযুক্তির ধাপসমূহ (Tissue culture process):
১। মাতৃউদ্ভিদ বা এক্সপ্লান্ট নির্বাচন (Maternal or implant selection): টিস্যু কালচারের জন্য সুস্থ,নীরোগ ও উৎকৃষ্ট বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত উদ্ভিদ থেকে টিস্যু সংগ্রহ করা হয়। সংগৃহীত টিস্যুকে এক্সপ্লান্ট (explant) বলে।
২। কালচার মিডিয়াম বা আবাদ মাধ্যম তৈরি (Creating culture medium): বিভিন্ন ধরনের মুখ্য ও গৌণ উপাদান (macro and micro elements), ভিটামিন, সুকরোজ (২-৪%), ফাইটোহরমোন প্রভৃতি এ মিডিয়ামে থাকা প্রয়োজন।
৩। জীবাণুমুক্তকরণ বা নির্বীজকরণ (Disinfection or sterilization): পাত্রটিকে নির্বীজকরণ যন্ত্র (autoclave) দিয়ে জীবাণুমুক্ত করা হয়। মিডিয়ামকে অটোক্লেভ যন্ত্রে নির্দিষ্ট তাপ (১২১° সে.), চাপ (১৫ পাউন্ড) ও সময় (২০ মিনিট) রাখা হয়।
৪। মিডিয়ামে এক্সপ্লান্ট বা টিস্যু স্থাপন (Place the implant or tissue in the medium): এক্সপ্লান্টকে নির্বীজ করে (সাথে হাত, চিমটা ইত্যাদিকে অ্যালকোহল দিয়ে নির্বীজ করতে হয়) সম্পূর্ণ নির্বীজ অবস্থায় কাচপাত্রে রাখা মিডিয়ামে স্থাপন করা হয়।
৫। ক্যালাস সৃষ্টি ও সংখ্যাবৃদ্ধি (Callus creation and multiplication): পাত্রটিকে একটি বৈদ্যুতিক আলো (৩,০০০-৫,০০০ লাক্স), তাপমাত্রা (১৭°-২০° সে.) ও আপেক্ষিক আর্দ্রতা (৭০-৭৫%) নিয়ন্ত্রিত কক্ষে রাখা হয়। কয়েকদিন পর টিস্যুটি বার বার বিভাজিত হয়ে একটি কোষীয় মণ্ডে পরিণত হয়। যে অবয়বহীন অবিন্যস্ত টিস্যুগুচ্ছ সৃষ্টি হয় তাই ক্যালাস। ক্যালাস থেকে এক সময় অসংখ্য মুকুল সৃষ্টি হয়।
৭। চারা টবে স্থানান্তর (Transfer seedlings to tubs): উপযুক্ত সংখ্যক সুগঠিত মূল সৃষ্টি হলে পূর্ণাঙ্গ চারাগাছ কালচার করা পাত্র থেকে সরিয়ে নিয়ে ধীর প্রক্রিয়ায় সাবধানতার সাথে টবে স্থানান্তর করা হয়। এভাবে টিস্যু কালচারের মাধ্যমে চারাগাছ উৎপাদন কাজ সম্পন্ন করা হয়।
৬ । মূল উৎপাদক মাধ্যমে স্থানান্তর ও চারা উৎপাদন (Transfer and seedling production through the main producer): মুকুলগুলোকে সাবধানে কেটে নিয়ে মূল উৎপাদনকারী মিডিয়ামে রাখা হয় এবং সেখানে প্রতিটি মুকুল, মূল সৃষ্টি করে পূর্ণাঙ্গ চারাগাছে পরিণত হয়।
৮। প্রাকৃতিক পরিবেশে তথা মাঠ পর্যায়ে স্থানান্তর (Transfer to natural environment as well as field level): টবসহ চারাগাছকে কিছুটা আর্দ্র পরিবেশে রাখা হয়, তবে রোপিত চারাগাছগুলো কক্ষের বাইরে রেখে মাঝে মাঝে বাইরের প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হয়। পূর্ণাঙ্গ চারাগাছগুলো সজীব ও সবল হয়ে উঠলে সেগুলোকে এক পর্যায়ে প্রাকৃতিক পরিবেশে মাটিতে লাগানো হয়।
টিস্যু কালচার প্রযুক্তির ব্যবহার (Application of plant tissue culture technology):
১। হুবহু মাতৃ-গুণাগুণসম্পন্ন চারা উৎপাদন বা মাইক্রোপ্রোপাগেইশন (Micropropagation): ভালোজাতের একটি উদ্ভিদ থেকে টিস্যু নিয়ে কালচার করে অনেক সংখ্যক চারাগাছ উৎপাদন করা সম্ভব হয়। অতি ক্ষুদ্র টিস্যু থেকে বহু চারা উৎপাদনের এ পদ্ধতি মাইক্রোপ্রোপাগেইশন নামেও পরিচিত।
২। রোগমুক্ত উদ্ভিদ সৃষ্টি (Creation of disease free plants)
৩। চারা উৎপাদন (Seedling production)
৪। বিলুপ্ত প্রায় উদ্ভিদ সংরক্ষণে (In conservation of almost extinct plants)
৫। ভ্রূণ কালচার প্রযুক্তির মাধ্যমে উদ্ভিদের কৃত্রিম প্রজনন (Artificial insemination of plants through embryo culture technology)
৬। সংকর উদ্ভিদ উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রোটোপ্লাস্ট ফিউশন (মিলন) (Protoplast fusion): প্রোটোপ্লাস্টের মিলনে সোমাটিক হাইব্রিড তৈরি হলে সেখানে দুটি প্রজাতির সম্পূর্ণ সাইটোপ্লাজমের মিলন ঘটে। শুধু সাইটোপ্লাজমের মিলনে সৃষ্ট উদ্ভিদকে হাইব্রিড না বলে সাইব্রিড (cybrid) বলা হয়। আলু ও টম্যাটো উদ্ভিদের প্রোটোপ্লাস্ট ফিউশন করে সৃষ্ট নতুন উদ্ভিদের নাম দেয়া হয়েছে পোম্যাটো।
৭। মেরিস্টেম কালচার (Meristem culture): উদ্ভিদের শীর্ষমুকুলের অগ্রভাগের টিস্যুকে মেরিস্টেম বলে। মেরিস্টেম কালচারের মাধ্যমে উৎপাদিত চারাগাছ সাধারণত রোগমুক্ত হয়ে থাকে।
৮। অল্প সময়ে অধিক চারা উৎপাদন (Produce more seedlings in less time)
৯। হ্যাপ্লয়েড উদ্ভিদ উৎপাদন (Haploid plant production): পরাগরেণু এবং পরাগধানী কালচার এর মাধ্যমে অ্যান্ড্রোজেনিক হ্যাপ্লয়েড উদ্ভিদ উৎপাদন করা সম্ভব। Poaceae, Solanaceae Brassicaceae গোত্রের হ্যাপ্লয়েড লাইন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছে।
১০। কোষ আবাদ ও ক্যালাস টিস্যু আবাদ (Cell implantation and callus tissue implantation): যেকোনো আবাদি উদ্ভিদ কোষ বা টিস্যু হতে সৃষ্ট প্রকরণকে বলে সোমাক্লোনাল ভ্যারিয়েশন। এর মাধ্যমে উন্নত কাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জীব উৎপন্ন করা হয়।
১১। দ্রুত ক্লোন সৃষ্টির মাধ্যমে বংশবিস্তার (Propagation through rapid clone creation)
১২। ট্রান্সজেনিক উদ্ভিদ সৃষ্টি (Creation of transgenic plants): টিস্যু কালচার প্রযুক্তিতে কোষ বা ভ্রূণ হতে পূর্ণাঙ্গ ট্রান্সজেনিক উদ্ভিদ সৃষ্টি করা যায়।
১৩। ভ্রূণ উদ্ধার (Embryo rescue)
১৪। দেহজ ভ্রূণ সৃষ্টি (Body embryo creation)
১৫। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন (Acquiring foreign currency)
একটি জীবের কোষ থেকে কোনো কাঙ্খিত DNA-অংশ রেস্ট্রিকশন এনজাইমের সাহায্যে কেটে নিয়ে অন্য জীবের কোষের DNA এর সাথে সংযুক্ত করার ফলে যে নতুন (মিশ্রিত) DNA উৎপন্ন হয় তাকে Recombinant DNA বলে।
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর জন্য যে পদ্ধতি বা টেকনোলজি প্রয়োগ করা হয় তাকে বলা হয় রিকম্বিনেন্ট DNA টেকনোলজি (recombinant DNA technology)।
রিকম্বিনেন্ট DNA প্রযুক্তির ধাপসমূহঃ
১. দাতা জীব থেকে কাঙ্খিত DNA অণুখণ্ড (জিন) আহরণ : (প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দাতা জীব থেকে যখন কাঙ্খিত DNA আহরিত হয় তখন তাকে প্যাসেঞ্জার DNA (passenger DNA) বলে। প্রত্যক্ষ উপায়ে DNA আহরণকালে প্রথমে দাতা জীবের কোষাবরণী ভেঙ্গে কোষীয় পদার্থ মুক্ত করা হয়। মুক্ত উপাদান থেকে সম্পূর্ণ DNA কে আলাদা করে রেস্ট্রিকশন এনজাইম (যেমন- E.coli)-এর সাহায্যে কাঙ্খিত DNA অণুকে কেটে ছোট খন্ডে পরিণত করা হয়। রেস্ট্রিকশন এনজাইম (restriction enzyme) কেবল DNA অণুর সুনির্দিষ্ট অনুক্রমে ফসফেট বন্ড মুক্ত করে DNA কে খন্ডিত করে।
ইউক্যারিওটিক জীবের ক্ষেত্রে পরোক্ষ উপায়ে DNA আহরণ করা হয়। কারণ এখানে অতিদীর্ঘ DNA অণুসূত্র থাকে যা থেকে কাঙ্খিত জিন পৃথক করা দূরূহ ব্যাপার। DNA'র ট্রান্সক্রিপশন (transcription)-এর সময় যে mRNA তৈরি হয় তা পৃথক করে তা থেকে রিভার্স ট্রান্সক্রিপটেজ (reverse transcriptase)-এর মাধ্যমে একসূত্রক সম্পুরক DNA (complementary DNA, সংক্ষেপে CDNA) সংশ্লেষণ করা হয়। এরপর DNA পলিমারেজ এনজাইমের সাহায্যে cDNA কে দ্বিসূত্রক DNA তে পরিণত করা হয়। উপরোক্ত যে কোনো উপায়ে সংগৃহীত DNA অণু বা জিন তখন রিকম্বিনেন্টের জন্য প্রস্তুত হয় ।
২. ভেক্টর (বাহক) DNA আহরণ : দাতা জীব থেকে সংগৃহীত কাঙ্খিত DNA খন্ডকে যে DNA অণুর সঙ্গে জুড়ে দিয়ে পরবর্তীকালে তার সংখ্যা বাড়ানো ও ব্যক্ত করানো হয়, তাকে বাহক বা ভেক্টর DNA বলে। এমন DNA কে বাহক হিসেবে নির্বাচিত করা হয় যা- (i) রেপ্লিকেশনে (প্রতিরূপ সৃষ্টিতে) সক্ষম; এবং (ii) পোষক কোষে প্রবেশের পর এর উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়া যায় প্লাজমিড (plasmid), ফাজ ভাইরাস ও কসমিড (cosmid)-এর ক্ষুদ্রাকৃতির DNA তে এসব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এগুলোর মধ্যে প্লাজমিডের ব্যবহারই সবচেয়ে বেশি।
৩. রিকম্বিনেন্ট DNA অণুর সৃষ্টি : প্যাসেঞ্জার DNA ও ভেক্টর DNA অণুকে রেস্ট্রিকশন এনজাইম দিয়ে এমনভাবে কেটে নেয়া হয় যেন প্রান্ত দুটি গাঁথন আকৃতি পায়। এ ধরনের এক সূত্রক বর্ধিত DNA প্রান্তকে গাঁথন প্রান্ত (sticky ends) বলে। এরপর প্যসেঞ্জার ও ভেক্টর DNA একসঙ্গে রেখে দিয়ে সেখানে লাইগেজ (ligase) সংযোজক এনজাইম প্রয়োগ করলে পরিপূরক প্রান্তগুলো পরস্পরের বিপুরীতে অবস্থান নিয়ে সম্পূরক নিউক্লিওটাইড অবস্থানে জোড়া লেগে যায় । এভাবে সৃষ্টি হয় রিকম্বিনেন্ট বা পুনঃসংযোজিত DNA অণু ।
8. পোষক কোষে রিকম্বিনেন্ট DNA অণুর প্রবেশকরণ : সৃষ্ট রিকম্বিনেন্ট DNA অণু একটি পোষক ব্যাকটেরিয়া কোষে প্রবেশ করানো হয়। স্বাভাবিক অবস্থায় ব্যাকটেরিয়া অন্য প্লাজমিড গ্রহণ করে না। Ca+ সমৃদ্ধ ++ করে Heat Shock এর মাধ্যমে বিশেষ পরিবেশ সৃষ্টি করলে প্লাজমিড গ্রহণ করতে পারে। প্লাজমিড গ্রহণ করলে ব্যাকটেরিয়ামকে রূপান্তরিত বা ট্রান্সফর্মড ব্যাকটেরিয়াম (transformed bacterium) বলে। DNA অণুপ্রবেশের অন্য একটি আধুনিক পদ্ধতি হলো Electroporation.
৫. রিকম্বিনেন্ট DNA অণুর সংখ্যা বৃদ্ধি ও ব্যক্তকরণ : রিকম্বিনেন্ট DNA অণু যুক্ত কোষ কালচার মিডিয়ামে রেখে এর বংশবৃদ্ধি করানো হয়। এ সময় কাঙ্খিতজিনবাহী প্লাজমিড পোষক কোষে বংশবৃদ্ধি করে। এভাবে, (পোষক দেহে রিকম্বিনেন্ট DNA-র অবিকল কপি সৃষ্টি করাকে জিন ক্লোনিং (gene cloning) বলে। কোষাভ্যন্তরে কাঙ্খিত জিন থেকে যে সব উপাদান সংশ্লেষিত হওয়ার কথা তা উৎপন্ন হলে বুঝতে হবে যে জিনের ক্লোনিং সঠিক ও সফল হয়েছে। সফল ক্লোনিং জিনের ব্যাপক বংশবৃদ্ধি ঘটিয়ে কাঙ্খিত উপাদান প্রাপ্তি ব্যাপকতর করা হয়। এখান থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রাপ্ত উপাদান সংগৃহীত হতে থাকে ।
রেস্টিকেশন এনজাইম : এক ধরনের এনজাইম যা বহিরাগত DNA অণুকে নির্দিষ্ট স্থানে কর্তন করতে পারে। "আণবিক কাঁচি" নামে পরিচিত এই এনজাইমগুলো বহু ব্যাকটেরিয়া কোষেই উৎপন্ন হয়। দাতা জীবদেহ থেকে কাঙ্খিত জিন সংগ্রহের জন্য এটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।
প্লাজমিডঃ জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর প্রধান জীবজ উপাদান হলো প্লাজমিড। ব্যাকটেরিয়ার সাইটোপ্লাজমে মূল ক্রোমোজোম ছাড়াও যে বৃত্তাকার বা রিং আকৃতির দ্বিসূত্রক DNA থাকে তাকে প্লাজমিড বলে। Lederberg 1952 সালে সর্বপ্রথম প্লাজমিড শব্দটি ব্যবহার করেন। কিন্তু বর্তমানে কেবল ব্যাকটেরিয়ার বহিঃক্রোমোজোমীয় DNA-কেই প্লাজমিড হিসেবে গণ্য করা হয়।
ব্যাকটেরিয়ার দেহে প্রধানত তিন ধরনের প্লাজমিড পাওয়া যায়- ৩ প্রকার
ক.F factor- এক ব্যাকটেরিয়া থেকে অন্য ব্যাকটেরিয়াতে জেনেটিক বস্তু স্থানান্তরের জন্য দায়ী।
খ.R plasmid- এদের মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন জিন রয়েছে।
গ.Col factor- এরা বিষাক্ত পদার্থ কোলিসিন উৎপাদন করার জন্য দায়ী।
প্লাজমিড-এর বৈশিষ্ট্যঃ
*বৃত্তাকার দ্বিসূত্রক DNA গঠিত স্বতন্ত্র জেনেটিক বস্তু।
*ব্যাকটেরিয়ার মূল ক্রোমোজোম হতে ছোট ও আলাদা ।
* অর্ধ-রক্ষণশীল প্রক্রিয়ায় প্রতিলিপন ক্ষমতাসম্পন্ন।
* অন্য প্লাজমিড বা ব্যাকটেরিয়ার মূল DNA অথবা অন্য যে কোন জীবের DNA-এর সাথে পুনঃসমন্বয় করতে সক্ষম।
* এক ব্যাকটেরিয়া হতে অন্য ব্যাকটেরিয়াতে স্থানান্তর হতে পারে।
Yeast
TMV
Chlorella
ক্লোন (clone) শব্দের অর্থ- হুবহু প্রতিরূপ। একটি কাঙ্খিত জিনের (DNA) অসংখ্য হুবহু কপি বা সংখ্যাবৃদ্ধি করার প্রক্রিয়াকে “জিন ক্লোনিং” বলে।
ব্যাকটেরিয়ার ভিতর ইউক্যারিওটিক জীবের DNA খন্ড প্রবেশ করিয়ে সেই DNA খন্ডকে এমনভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করা হয় যাতে ব্যাকটেরিয়া সেই DNA-র প্রতিলিপি গঠন করতে পারে। বর্তমানে জীবপ্রযুক্তিতে জিন ক্লোনিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জিন ক্লোনিং কতগুলো ধাপে সম্পন্ন করা হয়, ধাপগুলো নিম্নরূপঃ
১. যে জিন বা DNA খন্ডকে ক্লোন করা হবে তাকে কয়েকটি পদ্ধতি অবলম্বন করে সংগ্রহ করা হয়। এর জন্য রেস্ট্রিকশন এনজাইম (restriction enzyme) দিয়ে DNA কে খন্ড খন্ড করে বিশেষ DNA বা RNA প্রোব (probe) দ্বারা চিহ্ণিত করা হয়।
২. উপযুক্ত ভেক্টর বা বাহকের মধ্যে নির্বাচিত DNAটি প্রবেশ করিয়ে রিকম্বিনেন্ট DNA গঠন করা হয়। এ কাজ সম্পন্ন করার জন্য রেস্টিকসন এন্ডোনিউক্লিয়েজ এবং লাইগেজ এনজাইম ব্যবহৃত হয়। অনেক রকম ভেক্টর ব্যবহার করা হয়, তবে সাধারণত ব্যাকটেরিয়ার প্লাজমিড ভেক্টর হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
৩. এরপর নির্বাচিত DNA খন্ডটিসহ প্লাজমিড DNA-কে রিকম্বিনেন্ট DNA হিসেবে ব্যাকটেরিয়া বা অন্য পোষক কোষে প্রবেশ করানো হয়। প্লাজমিডকে ব্যাকটেরিয়া অথবা অন্য পোষক কোষে কয়েকটি পদ্ধতির মাধ্যমে প্রবেশ করানো হয়। পদ্ধতিগুলো হচ্ছে- (ক) ট্রান্সফেকশান (transfection), (খ) ইলেকট্রোপোরেশন (electroporation) এবং(গ) লাইপোজোমের মাধ্যমে । লাইপোজোম হচ্ছে চক্রাকার লিপিড অণু। নির্বাচিত DNA সহ প্লাজমিড পোষক কোষে প্রবেশ করেছে কিনা তা বিশেষ কতগুলো রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চিহ্ণিত করা হয় ।
৪. বহিরাগত নির্বাচিত DNA-র প্রতিরূপ সৃষ্টি করা হয়। এ ধাপে বহিরাগত DNA যুক্ত প্লাজমিডসহ ব্যাকটেরিয়া উপযুক্ত পুষ্টি মাধ্যমে বংশবৃদ্ধির জন্য রাখা হয়। কয়েক দিনের মধ্যে লক্ষ লক্ষ ব্যাকটেরিয়া উৎপন্ন হওয়ার সাথে সাথে সেই সংখ্যক রিকম্বিনেন্ট প্লাজমিডের প্রতিলিপি উৎপন্ন হয়। ফলে লক্ষ লক্ষ নির্বাচিত বহির্গত DNA-র বা জিনের ক্লোন গঠিত হয় বা ক্লোনিং সম্পন্ন হয়।
বর্তমান বিশ্বে রিকম্বিনেন্ট DNA প্রযুক্তি বহুল আলোচিত ও আশাপ্রদ একটি বিষয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। মানুষ অনেক ক্ষেত্রে এ প্রযুক্তির সফল ব্যবহারের মাধ্যমে উপকৃত হচ্ছে। অন্যদিকে ভবিষ্যতে DNA প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহারের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে এ প্রযুক্তির কয়েকটি প্রয়োগিক দিক নিচে আলোচনা করা হলো।
১. চিকিৎসাবিজ্ঞান : আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে রিকম্বিনেন্ট DNA প্রযুক্তি প্রভূত অবদান রাখছে এবং ভবিষ্যতে এর ব্যবহারে ব্যাপক সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। বিভিন্ন ধরনের ভ্যাকসিন, হরমোন, ইন্টারফেরন, অ্যান্টিজেন, অ্যান্টিবডি প্রভৃতি উৎপাদনে এ প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। অন্যদিকে রোগ শনাক্তকরণ ও জিন থেরাপির মাধ্যমে সুস্থ-সবল শিশুর জন্মদানে এ প্রযুক্তি বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। বহুমুত্র বা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত ইনসুলিন এই প্রযুক্তি ব্যবহার করেই উৎপাদন করা হয়।
২. কৃষিক্ষেত্রে : কৃষি উন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে রিকম্বিনেন্ট DNA প্রযুক্তি সফলভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। যেমন- - অধিক ফলনশীল শস্য উৎপাদনে চাষাবাদকৃত ফসলের কোন প্রজাতির মধ্যে সালোসংশ্লেষণে বেশি সক্ষম, নাইট্রোজেন সংবন্ধন ক্ষমতা সম্পন্ন, ফল অধিক পৃষ্টকরণ ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য স্থানান্তরের মাধ্যমে অধিক ফলনশীল জাত উৎপাদন করা যায়।
পুষ্টিগুণ বৃদ্ধিতে : সুইস বিজ্ঞানী Ingo Potrykus ও জার্মান বিজ্ঞানী (Peter Beyer B-ক্যারোটিনসমৃদ্ধ এক প্রকার বিশেষ ধান আবিষ্কার করেন যাকে সোনালী ধান (Golden rice) বলা হয়। চাষাবাদকৃত ধানের জাতগুলোর মধ্যে এ বৈশিষ্ট্য অনুপস্থিত। কৃষি গবেষণায় এটি একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার এবং ভবিষ্যতে এ গবেষণার নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে।
আগাছানাশক প্রতিরোধী উদ্ভিদ সৃষ্টিতে : বিভিন্ন উদ্ভিদে আগাছানাশক প্রতিরোধী জিন প্রতিস্থাপরের মাধ্যমে উদ্ভিদকে আগাছানাশক প্রতিরোধি করা সম্ভব হয়েছে। এই প্রযুক্তিতে Streptomyces hygroscopicus নামক ব্যাকটেরিয়া থেকে পৃথক করা জিন টমেটো, তামাক ও আলুতে স্থানান্তর করে এই বিশেষ বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি করা হয়েছে। গ্লাইকোস্টে একটি আগাছা নিধনকারী পদার্থ যা পৃথিবীর সবচেয়ে মারাত্মক ৭৮ আগাছারমধ্যে ৭৬টি ধ্বংস করতে পারে।
রোগপ্রতিরোধি জাত উদ্ভাবনে ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক ও নানা রকম কীট-পতঙ্গ প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবনে এ প্রযুক্তি সাফল্যের সাথে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন- টোবাকো মোজাইক ভাইরাস (TMV)-এর আক্রমণ থেকে তামাক গাছ প্রতিরোধী হয়েছে।
দ্যুতিময় উদ্ভিদ সৃষ্টিতে : কোনাকি পোকার দেহে লুসিফারেজ এনজাইমের প্রভাবে লুসিকেরিন নামক পদার্থের ক্ষরিত হয়ে আলোর সৃষ্টি হয়। জোনাকি পোকার আলো সৃষ্টিকারী জিন রিকম্বিনেন্ট DNA প্রযুক্তির মাধ্যমে তামাক গাছে প্রতিস্থাপনের ফলে তামাক গাছ থেকে আলো বিচ্ছুরিত হয়।
গুণগত মান উন্নয়নে : যে সমস্ত ভেড়া ক্লোভার জাতীয় ঘাস খায় তাদের লোম নিম্ন মানের হয় । কারণ এতে সালফার কম থাকে। রিকম্বিনেন্ট DNA প্রযুক্তি ব্যবহার করে সূর্যমুখী থেকে সালফার অ্যামিনো এসিড সৃষ্টিকারী জিনের মাধ্যমে ক্রোভার ঘাসে স্থানান্তর করা হয়েছে। এ ক্লোভার ঘাস খেলে সেসব ভেড়ায় উন্নতমানের লোম পাওয়া যায়।
বীজহীন রুপ সৃষ্টিতে : বর্তমানে রিকম্বিনেন্ট DNA প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনেক দেশে বীজহীন ফল তৈরি করা হচ্ছে। যেমন-জোপানে বীজহীন তরমুজ, আঙ্গুর উৎপাদন ইত্যাদি।
৩. এনজাইম প্রযুক্তি : উন্নত এনজাইম বা প্রোটিন (যেমন থোমাটিন যা ০.৬% সুক্রোজ দ্রবণের চেয়ে ৫,৫০০ গুণ বা স্যাকারিন থেকে ৩০০ গুণ বেশি মিষ্টি) ইত্যাদি উৎপাদনে রিকম্বিনেন্ট DNA প্রযুক্তি সাফল্যের সাথে ব্যবহৃত হয়েছে। অধিক ক্রিয়াশীল কিছু এনজাইম তৈরিতে এ পদ্ধতি গৃহীত হচ্ছে।
৪. পেস্টিসাইড শিল্পে: অর্থের অপচয় ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় তথা উপকারী অণুজীব বা কীট-পতঙ্গ টিকিয়ে রেখে রোগ জীবাণু দমনে বর্তমানে এ প্রযুক্তিতে উদ্ভাবিত ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস ব্যবহৃত হচ্ছে। ভবিষ্যতে এ প্রযুক্তির মাধ্যমে কীটনাশক উৎপাদনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
৫. পরিবেশ ব্যবস্থাপনায় : রিকম্বিনেন্ট DNA প্রযুক্তি ব্যবহার করে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন বিভিন্ন অণুজীব সৃষ্টি করা হচ্ছে যা বিভিন্ন বর্জ্য, পয়ঃনিষ্কাশন, শিল্প বর্জ্য, তেল ইত্যাদি পরিশোধনের মাধ্যমে দূষণ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অবদান রাখছে।
মানুষের অন্যতম প্রধান মৌলিক চাহিদা খাদ্য। কৃষি উন্নয়নে যে সব জীবপ্রযুক্তিগত পদ্ধতি ব্যবহৃত হয় নিচে সেগুলোর বর্ণনা দেওয়া হলো ।
১. টিস্যু কালচার (আবাদ) : এ পদ্ধতিতে উদ্ভিদের বর্ধনশীল (meristematic) অঙ্গের ক্ষুদ্র অংশ; যেমন মূল, কাণ্ড, পাতা, অঙ্কুরিত চারার বিভিন্ন অংশ ইত্যাদি নির্ধারিত পুষ্টিমাধ্যমে এবং জীবাণুমুক্ত ও নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে আবাদ করা হয়। এই কালচারের ফলে এসব বর্ধনশীল অঙ্গ থেকে অসংখ্য ক্ষুদ্রচারা উৎপন্ন হয়। এসব ক্ষুদ্রচারার প্রত্যেকে পরে উপযুক্ত পরিবেশে পৃথক পৃথক পূর্ণাঙ্গ উদ্ভিদে পরিণত হয় ।
২. অধিক ফলনশীল উদ্ভিদের জাত সৃষ্টি : কোন বন্য উদ্ভিদের উৎকৃষ্ট জিন ফসলী উদ্ভিদে প্রতিস্থাপন করে কিংবা জিনের গঠন বা বিন্যাসে পরিবর্তন ঘটিয়ে উন্নত জাতের উদ্ভিদ সৃষ্টি করা হয়। এভাবে ধান, গম, তেলবীজ সহ অনেক শস্যের অধিক ফলনশীল উন্নত জাত উদ্ভাবন করা হয়।
৩. গুণগত মান উন্নয়নে : জীবপ্রযুক্তি প্রয়োগ করে প্রাণী ও উদ্ভিদজাত দ্রব্যাদির গঠন, বর্ণ, পুষ্টিগুণ, স্বাদ ইত্যাদির উন্নয়ন করা সম্ভব হয়েছে। যেমন- অস্ট্রেলিয়ায় ভেড়ার লোমকে উন্নতমানের করতে তাদের খাদ্যে ক্লোভার ঘাসে রিকম্বিনেন্ট DNA প্রযুক্তির মাধ্যমে সূর্যমুখীর সালফার অ্যামিনো এসিড সৃষ্টিকারী জিন স্থানান্তর করা হয়েছে। ফলে খাদ্য হিসেবে এই ঘাস খেলেই ভেড়ার লোম উন্নতমানের হচ্ছে, পৃথকভাবে সালফার সমৃদ্ধ খাবার দেয়ার প্রয়োজন হচ্ছে না।
৪. সুপার রাইস সৃষ্টি : সুইডেনের বিজ্ঞানী /Potrykus ও তাঁর সহযোগীরা সুপার রাইস বা গোল্ডেন রাইস নামক এক ধরনের ধান উদ্ভাবন করেছেন। তাঁরা জীবপ্রযুক্তির মাধ্যমে Japonica টাইপ ধানে ড্যাফোডিল উদ্ভিদের বিটা ক্যারোটিন ও আয়রন উৎপাদন জিন প্রতিস্থাপন করে সুপার রাইস উদ্ভাবন করেন। এ ধানের ভাত খেলে শিশুরা ভিটামিন ও আয়রনের অভাবজনিত রোগে আক্রান্ত হবে না। এতে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার কোটি কোটি শিশু পুষ্টিহীনতা থেকে রক্ষা পাবে।
৫. ভিটামিন সমৃদ্ধ ভূট্টার জাত সৃষ্টি : সম্প্রতি (এপ্রিল, ২০০৯) স্পেনের ইউনিভার্সিটি অব এলইয়েডার গবেষক ড. পল ক্রিস্টো এবং তাঁর সহকর্মীরা জেনেটিক্যালি মডিফাইড M-37W প্রকরণের ভূট্টার বীজ উদ্ভাবন করেছেন যাতে ভিটামিন সি, বিটা ক্যারোটিন ও ফলিক এসিড পাওয়া যাবে। এক শস্যে তিন ধরনের ভিটামিন থাকায় এই ভুট্টা ব্যালেন্স ডায়েটের পাশাপাশি গরীব দেশগুলোর মানুষের অপুষ্টি দূর করবে।
৬. স্টেরাইল ইনসেক্ট টেকনিক : শাক-সব্জি, ফল ও শুটকির ক্ষতিকর পতঙ্গ, মশা ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণে স্টেরাইল ইনসেক্ট টেকনিক (SIT) একটি আধুনিক জীব প্রযুক্তি। পুরুষ পতঙ্গকে রেডিয়েশন দ্বারা বন্ধ্যাকরণ করে এই প্রযুক্তিতে পতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ করা হয়। জাপান, ফিলিপিনস, থাইল্যান্ড, গুয়াতেমালা, ব্রাজিল, হাওয়াই প্রভৃতি দেশে এই প্রযুক্তি ব্যাপক প্রচলিত। বাংলাদেশের সাভারে অবস্থিত পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের Insect Biotechnology Laboratory-র একদল বিজ্ঞানী সব্জির পোকা Bacocera cucurbitae-কে এই প্রযুক্তিতে নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যাপক গবেষণা করছেন।
৭. দূর সংকরায়ন ও ভ্রূণ উদ্ধার ( Wide hybridization and embryo rescue ) : কাঙ্খিত বৈচিত্র্যের মাত্রা বাড়ানোর আরেক কৌশল হচ্ছে আস্তঃপ্রজাতিক (interspectific) ও আন্তঃগণিক (intergeneric) সংকরায়ন। এর ফলে চাষযোগ্য শস্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, ফলনশীলতা ও অভিযোজন ক্ষমতা বেড়েছে।
৮. পুংকেশর ও পরাগ কালচার (Anther and microspore culture): অধুনা দূর সংকরায়ন ও ভ্রণ উদ্ধার এবং পুংকেশর কালচারের মাধ্যমে হ্যাপ্লয়েড উদ্ভিদ সৃষ্টি করা হচ্ছে। এসব পদ্ধতির মধ্যে পুংকেশর কালচারের পদ্ধতিই বেশি ব্যবহৃত হয়। ১৯৬৭, খ্রিস্টাব্দে থেকে গম, বার্লি, ভুট্টা, ধান, রাই, তুলা, আলু, তামাক প্রভৃতি শস্য প্রজাতির হ্যাপ্লয়েড উদ্ভিদ উদ্ভাবনের জন্য ব্যাপক ব্যবহৃত হচ্ছে।
৯. ট্রান্সজেনিক উদ্ভিদ (Transgenic plants) প্রকৌশলের মাধ্যমে জিনের স্থানান্তর ঘটিয়ে যে সব উদ্ভিদ সৃষ্টি করা হয় সেগুলোকে ট্রান্সজেনিক উদ্ভিদ বলে। এ প্রক্রিয়ায় রিকম্বিনেন্ট DNA কৌশল প্রয়োগ করে উৎপন্ন জীবকে হয় কোনো বাহকের মাধ্যমে নয়তো মাইক্রোইঞ্জেকশনের মাধ্যমে উদ্ভিদের প্রোটোপ্লাস্টে প্রবেশ করানো হয়। বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রায় ৬০টি উচ্চতর উদ্ভিদ প্রজাতিতে এ প্রক্রিয়ার সফল প্রয়োগ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে তামাক, টম্যাটো, আলু, মিষ্টি আলু, লেটুস, সূর্যমুখী, বাঁধাকপি, তুলা, সয়াবিন, মটর, শসা, গাজর, মূলা, পেঁপে, আঙ্গুর কৃষ্ণচূড়া, গোলাপ, আপেল, নাশপাতি, নিম, ধান, গম, রাই, ভূট্টা প্রভৃতি।
ট্রান্সজেনিক উদ্ভিদ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থকরী ফসলকে আগাছানাশক, পতঙ্গ, ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক প্রতিরোধী করে উৎপাদন করা হচ্ছে। অনেক উদ্ভিদকে উষ্ণতা, শৈত্য, লবণাক্ততা, ভারী ধাতু, ফাইটোহরমোন, নাইট্রোজেন প্রভৃতি মোকাবিলায় সক্ষম করে তোলা হয়েছে। পাকা টমেটোর ত্বক নরম হয়ে যাওয়া প্রতিরোধে কিংবা দেরীতে পাকানো অথবা সুক্রোজের পরিমাণ বাড়িয়ে স্টার্চের পরিমাণ কমিয়ে টম্যাটো উৎপাদন ট্রান্সজেনিক প্রক্রিয়ারই সুফল। আলুতে ২০-৪০% স্টার্চ বাড়ানোও সম্ভব হয়েছে এ প্রক্রিয়ায়।
চিকিৎসাঃ
পৃথিবীর প্রায় তিন-চতুর্থাংশ মানুষই সুচিকিৎসা থেকে বঞ্চিত। অথচ প্রতি বছর জনসংখ্যা ও রোগের জটিলতা বেড়েই চলেছে। এ অবস্থায় দ্রুত চিকিৎসা সুবিধা পৌঁছে দিতে বিজ্ঞানীরা জীব প্রযুক্তির আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলে দ্রুত ঔষধ (drugs) শিল্পের উন্নতি ঘটছে। মারাত্মক রোগ ব্যাধি শনাক্তকরণের পাশাপাশি জীবপ্রযুক্তির মাধ্যমে ওষুধ উৎপাদনের প্রক্রিয়া জোরালো হয়েছে। নিচে তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া হলোঃ
১. ভ্যাকসিন উৎপাদন : প্রাণিদেহে রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে স্থায়ী প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য ভ্যাকসিন বা টিকা ব্যবহার করা হয় । আগে প্রাণিদেহ থেকে অ্যান্টিজেন পৃথক করে ভ্যাকসিন উৎপাদন করা হতো । বর্তমানে জিন প্রকৌশল প্রযুক্তি প্রয়োগ করে ব্যাপকভাবে বিভিন্ন ভ্যাকসিন উৎপাদন করা হচ্ছে যা পোলিও, যক্ষ্মা, হাম, বসন্তসহ বিভিন্ন সংক্রামক রোগের চিকিৎসায় প্রয়োগ হচ্ছে।
২. মানব ইনসুলিন উৎপাদনঃ মানুষের ডায়াবেটিক রোগের চিকিৎসায় ইনসুলিন হরমোন ব্যবহার করা হয়। আগে গরু ও শুকরের অগ্ন্যাশয় থেকে বাণিজ্যিকভাবে এ হরমোন সংগ্রহ করা হত। কিন্তু বর্তমানে মানুষের ইনসুলিন উৎপাদনকারী জিন ব্যাকটেরিয়ায় স্থাপন করে রিকম্বিনেন্ট DNA প্রযুক্তিতে বাণিজ্যিকভাবে ইনসুলিন উৎপাদন করা হচ্ছে। ফলে এটি যেমন সহজলভ্য হচ্ছে তেমনি এর কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও নেই ।
৩. মানব গ্রোথ হরমোন উৎপাদন : মানুষের দৈহিক বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণকারী সোমাটোট্রফিন হরমোন উৎপাদনকারী জিনকৈ ব্যাকটেরিয়ার প্লাজমিডে জুড়ে দিয়ে রিকম্বিনেন্ট DNA প্রযুক্তিতে বাণিজ্যিকভাবে মানব গ্রোথ হরমোন উৎপাদন করা হচ্ছে। এ হরমোন বামনত্ত্ব চিকিৎসায় ব্যবহৃত হচ্ছে।
৪. ইন্টারফেরন উৎপাদন (ইন্টারফেরন এক ধরনের উচ্চ আণবিক ওজন সম্পন্ন প্রোটিন যা ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি ও ভাইরাসের বংশবৃদ্ধিতে বাধা দেয় । (স্বাভাবিক অবস্থায় ভাইরাস আক্রান্ত হওয়ার দু-একদিনের মধ্যেই মানবদেহের অধিকাংশ কোষ ইন্টারফেরন উৎপন্ন করে। ইন্টারফেরন রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। হেপাটাইটিস-এর চিকিৎসায় বর্তমানে E. coli ও ঈস্ট থেকে জিন প্রকৌশল প্রযুক্তির মাধ্যমে বাণিজ্যিকভাবে ইন্টারফেরন উৎপাদন করা হচ্ছে।
৫. বংশগতিয় রোগ নিরাময়ে : মানুষের প্রায় তিন হাজার বংশগতিয় রোগ আছে এসব রোগের কোন চিকিৎসা নেই। যেসব জিন দ্বারা এ সব রোগ সৃষ্টি হয় জিন প্রকৌশল প্রযুক্তি দ্বারা সেসব জিনকে অপসারণ বা প্রতিস্থাপন করে রোগ নিরাময়ের চেষ্টা চলছে।
৬. গর্ভের শিশু পরীক্ষা : মাতৃগর্ভের শিশু কোন বংশগত বা অন্য কোন অস্বাভাবিকতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে কি না তা "ড্রামনিওসিস" নামক জিন প্রযুক্তি দ্বারা নিরূপণ করা যায়।
৭. এনজাইম উৎপাদন : জিন প্রকৌশল প্রযুক্তি প্রয়োগ করে খাদ্য হজমকারী বিভিন্ন এনজাইম, যেমন-জাইমেজ, প্রোটিয়েজ, লাইপেজ; কৃমিনাশক এনজাইম ফাইসিন ইত্যাদি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করা হচ্ছে।
৮. ট্রান্সজেনিক প্রাণী থেকে ওষুধ আহরণ : ট্রান্সজেনিক প্রাণী - উদ্ভাবনের মাধ্যমে প্রাণিগুলোকে "বায়োরিএক্টর" হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এসব প্রাণীর দুধ, রক্ত ও মূত্র থেকে প্রয়োজনীয় ওষুধ আহরণ করা হয়। একে মেলিকুলার ফার্মিং বলে।
ইনসুলিন (Insulin):
অগ্ন্যাশয় (pancreas)-এর আইলেটস অব ল্যাঙ্গারহ্যান (Islets of Langerhans) পর্যবেক্ষণের সময় ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে Sir Edward Sharpy Schafer সর্বপ্রথম ইনসুলিন নামক হরমোন আবিষ্কার ও নামকরণ করেন। ইনসুলিনের বহুমূত্র (diabetes) বিরোধী ভূমিকার কথা ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম উল্লেখ করেন কানাডীয় দুই বিজ্ঞান। Frederick Grant Banting এবং Charles Herbert Best, ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সর্বপ্রথম ১৯২২ খ্রিস্টান সফলভাবে নয় বছরের এক বালকের দেহে ইনসুলিন প্রয়োগ করা হয়। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে Eli Lilly and Company নামক আমেরিকান এক ঔষধ কোম্পানী বাণিজ্যিকভাবে ইনসুলিন উৎপাদনে সচেষ্ট হয় এবং তখন পৰাদি পশু ও অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিন আহরণ ও বাজারজাত করা হয়। প্রায় ৮০০-১০০০ কেজি অগ্ন্যাশয় থেকে মাত্র ১০০ গ্রাম ইনসুলিন আহরিত হয়। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের Federick Sanger ও সহগবেষকরা সর্বপ্রথ ইনসুলিনের আণবিক গঠন আবিষ্কারে সফল হন। ইনসুলিন হচ্ছে অন্যতম ক্ষুদ্রতম প্রোটিন। এটি A ও B নামক দুটি পলিপেপটাইড শৃঙ্খল নিয়ে গঠিত।
গবাদি পশু ও - অগ্ন্যাশয় থেকে আহরিত ইনসুলিনে অ্যামিনো এসিডের পর্যায়ক্রম (sequence) প্রায় মানব ইনসুলিনের মতোই। জন্তুর ইনসুলিনে ডায়াবেটিসের অধিকাংশ নিয়ন্ত্রিত হলেও বৃদ্ধ ও রেটিনা বিনাশ সহজে ঠেকানো যায় না। তাছাড়া এতে খরচও পড়ে অনেক বেশি।
জীবপ্রযুক্তির মাধ্যমে বাণিজ্যিক উপায়ে ইনসুলিন উৎপাদনঃ
ডায়াবেটিস মানুষের একটি অতি পরিচিত রোগের নাম। গ্লুকোজ বিপাক স্বাভাবিকভাবে না হলে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যায় এবং দেহ থেকে প্রস্রাবের মাধ্যমে বের হয়ে যায়। গ্লুকোজের বিপাকের জন্য ইনসুলিন একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ইনসুলিন এক ধরনের হরমোন যা অগ্ন্যাশয়ের বিটা কোষ থেকে প্রাকৃতিক নিয়মে নিঃসৃত হয়। ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসায় প্রচুর পরিমাণে ইনসুলিন প্রয়োজন। এক সময় গরু ও অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিন সংগ্রহ করে তা মানুষের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হতো। বর্তমানে জীবপ্রযুক্তির মাধ্যমে ইনসুলিন উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে। প্রক্রিয়াটি নিচে বর্ণিত উপায়ে ব্যাখ্যা করা যায়।
১. জিন শনাক্তকরণঃ এ প্রক্রিয়ার শুরুতেই মানুষের ক্রোমোজোমে ইনসুলিন-জিনের অবস্থান চিহ্নিত ও শনাক্ত করে নিতে হয়।
২. কাঙ্খিত জিন আহরণঃ একজোড়া রেস্ট্রিকশন এনজাইম ব্যবহার করে DNA সূত্রক থেকে জিনের দুই প্রান্ত কেটে আঠালো গাঁথন প্রান্তসহ DNA-খন্ডটিকে পৃথক করে নিতে হয়।
৩. প্লাজমিড আহরণঃ ভেক্টর বা বাহক হিসেবে ব্যবহারের জন্য Ecoli ব্যাকটেরিয়াম থেকে প্লাজমিড বের করে নেয়া হয় । এখানেও একজোড়া রেস্ট্রিকশন এনজাইম প্রয়োগ করে প্লাজমিডের অংশ কেটে ইনসুলিন জিন বসানোর মত জায়গা এবং আঠালো গাঁথন প্রান্ত সৃষ্টি করা হয়।
৪. প্লাজমিডে ইনসুলিন-জিন স্থাপনঃ মানুষের ইনসুলিন-জিনটি এ ধাপে E. coli প্লাজমিডের কর্তিত অংশে বসিয়ে লাইপেজ এনজাইমের সাহায্যে জুড়ে MAT দেয়া হয়। এভাবে সৃষ্টি হয় রিকম্বিনেন্ট প্লাজমিড (recombinant plasmid)
৫. ট্রান্সফরমেশন প্রক্রিয়াঃ এ প্রক্রিয়ায় একটি ব্যাকটেরিয়াম পরিবেশ থেকে কোষঝিল্লির মাধ্যমে জেনেটিক পদার্থ গ্রহণ করে নিজের জিনগত অবস্থার কর্তিত প পরিবর্তন ঘটায়। এ প্রক্রিয়ায় "প্লাজমিডমুক্ত Ecoli ব্যবহৃত হয়।
৬. ফার্মেন্টারে বৃদ্ধিঃ ট্রান্সজেনিক ব্যাকটেরিয়া . নির্দিষ্ট কালচার মিডিয়ামযুক্ত ফার্মেন্টারের ভিতরে রেখে দেয়া হয়। একটি ব্যাকটেরিয়া যতোবার বিভাজিত হয় ততোবারই মানব ইনসুলিন জিনবাহী রিকম্বিনেন্ট প্লাজমিডও বিভক্ত হয়। ইনসুলিন-জিনের নির্দেশে প্রত্যেক ব্যকিটেরিয়া ইনসুলিন উৎপন্ন করে সাইটোপ্লাজমে জমা করে ।
৭. ইনসুলিন আহরণঃ প্রতিটি ফার্মেন্টারের কালচার মিডিয়াম থেকে ব্যকটেরিয়া সংগ্রহ করে তা থেকে ইনসুলিন আহরণ করা হয়।
টান্সফরমেশন প্রক্রিয়াঃ একটি বিশেষ পাত্রে Ecoli- যুক্ত দ্রবণে রিকম্বিনেন্ট প্লাজমিডগুলোকে মিশিয়ে দেওয়া হয়। বিশেষ পাত্রটি তখন ইলেক্ট্রোপোরেশন যন্ত্রে (electroporation machine) স্থাপন করে ওই বিশেষ যন্ত্রে নির্দিষ্ট মাত্রায় বৈদ্যুতিক শক দেয়া হয়। এতে ব্যাকটেরীয় কোষের রুদ্ধ যথেষ্ট উন্মুক্ত হলে প্লাজমিড রন্ধ্রপথে ব্যাকটেরীয় কোষে প্রবেশ করে। ব্যাকটেরিয়া প্লাজমিড ধারণ করে রূপান্তরিত বা ট্রান্সফর্মড (transformed) কোষে পরিণত হয়। এটিই ট্রান্সফরমেশন প্রক্রিয়া। পরিবর্তিত এসব ব্যাকটেরিয়াকে ট্রান্সজেনিক ব্যাকটেরিয়া (transgenic bacteria) নামেও অভিহিত করা হয়।
ইন্টারফেরন (Interferon):
ইন্টারফেরন শব্দের উৎপত্তি হয়েছে ভাইরাসজনিত interference অর্থাৎ ব্যাঘাত থেকে শরীরে ভাইরাস অনুপ্রবেশের পর এদের প্রচন্ড কর্মক্ষমতার জন্য বিজ্ঞানীদের নজর কেড়ে নিয়েছে ইন্টারফেরুন। Alec Issacs এবং Jean Lindenmann সর্বপ্রথম ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে ইন্টারফেরন আবিষ্কার করেন।
দেহের ভিতর স্বতঃস্ফূর্তভাবে তৈরি ভাইরাসজনিত আক্রমণ প্রতিরোধী প্রোটিন জাতীয় পদার্থকে ইন্টারফেরন বলে । এটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রোটিনের একটি গ্রুপ। কোনো দেহকোষ বিশেষ ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হলে তার প্রতি সাড়া দিয়ে সংক্রমিত কোষ ইন্টারফেরন নামক রাসায়নিক পদার্থ (গ্লাইকো-প্রোটিন) নিঃসরণ করে। নিঃসৃত ইন্টারফেরন আক্রমণকারী ভাইরাসের প্রোটিন সংশ্লেষণ করে।
ইন্টারফেরন মানবদেহে নিচেবর্ণিত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে-
*এরা দেহাভ্যন্তরে ভাইরাসের বংশবৃদ্ধি প্রতিরোধ করে
* পোষকের অনাক্রম্য কোষকে উত্তেজিত করে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করে
* ইম্যুনতন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করে
* অ্যান্টিবডি উৎপাদন প্রতিরোধ করে
* B ও T লিম্ফোসাইটের সংখ্যাবৃদ্ধিকে দমন করে
* NK কোষের (Natural Killar Cells)-এর ক্ষমতা ও বংশবৃদ্ধির মাধ্যমে ক্যান্সার কোষের সংখ্যাবৃদ্ধিকে বাধা দেয়
* ভাইরাসজনিত অসুখে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করে এটি নাসিকাপথে, পেশিতে বা রক্তস্রোতেও প্রয়োগ করা যায়।
জীবপ্রযুক্তির মাধ্যমে ইন্টারফেরন উৎপাদনঃ
জিন ক্লোনিং-এর মাধ্যমে আমেরিকার দুই বিজ্ঞানী Gilbert এবং Weissmann ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে সাফল্যের সাথে মানব ইন্টারফেরন উৎপাদনে সক্ষম হয়েছেন। এরপর জাপান, ইসরাইয়েল, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, বেলজিয়ামও ইন্টারফেরন উৎপাদনে এগিয়ে আসে।
আগে প্লাজমিড বাহকের মাধ্যমে ক্লোনড জিনের সাহায্যে Ecoli ব্যাকটেরিয়ার ভিতরে ইন্টারফেরন উৎপাদিত হতো; এখনও অবশ্য হয়। তবে ঈস্ট কোষে কয়েকগুণ বেশি ইন্টারফেরন উৎপন্ন হয় বলে বর্তমানে ক্লোনড জিনকে প্লাজমিড বাহকের মাধ্যমে Saccharomyces cerevisiae-র কোষে ঢুকিয়ে ইন্টারফেরন উৎপাদিত হচ্ছে। প্রতিকোষে প্রায় এক মিলিয়ন (দশ লক্ষ) অণু ইন্টারফেরন তৈরি হয়।
একদল বিজ্ঞানী ইন্টাফেরনের সংকেত বহনকারী পুরো একটি জিন-ই সংশ্লষ করতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁরা ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে যুক্তরাজ্যের Imperial Chemical Industries (ICI) এবং University of Leicester-এর জিনকে একটি প্লাজমিডের সাথে যুক্ত করে E. coli এবং Methylophilous methylotrophus-এর ভিতর ঢুকিয়ে দিয়ে ইন্টারফেরন উৎপাদনে সফলতাও দেখিয়েছেন।
মলিকুলার ফার্মিংঃ ট্রান্সজেনিক প্রাণী উদ্ভাবনের মাধ্যমে তাদেরকে বায়োরিঅ্যাক্টর হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এধরনের প্রাণী থেকে দুধ, রক্ত ও মলমূত্র থেকে প্রয়োজনীয় ঔষধ আহরণ করা হয়ে থাকে। এ পদ্ধতিকে মলিকুলার ফার্মিং বলে।
i. কলকারখানা ও খনি থেকে নির্গত বর্জ্য : পেট্রোলিয়াম কারখানা থেকে নির্গত বর্জ্য পদার্থে এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া জন্মায় যা Single cell protein হিসেবে পশু ও মানুষের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অনুজীবের সহায়তায় দুধের (Dairy) কারখানা থেকে নির্গত বর্জ্য (whey) থেকে Lactic acid তৈরি হয়।
ii. সমুদ্রে তেল নির্গমন : Pseudomonas, Nocardia, Mycobacterium বিশেষ ধরনের ঈষ্ট ও মোল্ড জাতীয় ছত্রাক হাইড্রোকার্বন অক্সিডাইজিং অনুজীব হিসেবে কাজ করে।
iii. সিউয়েজ আত্তীকরণ : Sewerage অনুজীব বায়বীয় বা অবায়বীয় ব্যাকটেরিয়াসহ শৈবাল, ছত্রাক, প্রোটোজোয়া এ প্রক্রিয়ায় অংশ নেয় তখনও জৈব পদার্থকে (sewerage পদার্থকে) ভেঙ্গে CO2 ও CH, এ পরিণত করে H, গ্যাসীয় অবস্থায় বায়ুমণ্ডলে ছাড়া হয় এবং CH, জ্বালানী হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
একটি জীবকোষে অবস্থিত জিন সমষ্টিকে একত্রে জিনোম বলা হয়। একটি জীবের জিনোমকে ঐ জীবের ‘মাস্টার ব্লুপ্রিন্ট' বলা হয়। DNA অণুর অনুৈেদর্ঘ্যে ATGC বেসগুলো কোনো অনুক্রমে (কোনোটির পর কোনোটি) সজ্জিত থাকে তা হলো জিনোম সিকোয়েন্স, আর এই সিকোয়েন্সটি (সাজান পদ্ধতিটি) উদঘাটন করাই হলো জিনোম সিকোয়েন্সিং বা DNA সিকোয়েন্সিং। জিনোমসিকোয়েন্সিং-এর প্রবর্তক হলেন Dr. F. Sanger.
পাটের জীবনরহস্য উন্মোচন বা জিনোম সিকোয়েন্সিং : বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ড. মাকসুদ আলম ও তাঁর সহযোগীরা তোষা পাটের(Corchorus olitorius) জিনোম সিকোয়েন্সিং তথা পাটের জীবনরহস্য উন্মোচন করেছেন। পাটের বেস পেয়ার ১২০ কোটি। এরা কোন অনুক্রমে সজ্জিত আছে তা জানা হয়েছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা জিনোম সিকোয়েন্সিং জানার ফলে এখন উদ্ভাবন করা সম্ভব। হবে মিহি আঁশের পার্ট, শীতকালীন পাট, সহজে পচনযোগ্য পাট, পোকা প্রতিরোধক পাট, ওষুধী পাট, তুলার মতো শক্ত আঁশের পাট ইত্যাদি।
ফসল উদ্ভিদে রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্সিং : মুগডাল বাংলাদেশের একটি অন্যতম ডাল উৎপাদনকারী উদ্ভিদ। কিন্তু হলুদ মোজাইক ভাইরোসের আক্রমণে এই ফসলের উৎপাদন অধিকাংশ হ্রাস পায়। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ নূরুল ইসলাম ও গবেষণা সহযোগী দল বাংলাদেশের মুগের হলুদ রোগ উাদনকারী ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্সিং করেন এবং RNAi পদ্ধতি ব্যবহার করে হলুদ মোজাইক ভাইরাস প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবনের গবেষণা করছেন। তাঁর দল ICGEB-এর আর্থিক সহায়তায় টমোটোর পাতা কোকড়ানো রোগ সৃষ্টিকারী ToLCV ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্সিং সম্পন্ন করেছেন।
জিনোম সিকোয়েন্সিং প্রয়োগঃ
১। যে কোনো প্রকৃতির জীব থেকে নিবেশষ কোনো জিনকে শনাক্ত করা এবং পরবর্তীতে পৃথক করা; যেমন- মানুষের ইনসুলিন উৎপাদনকারী জিন। এটি ১১ নং ক্রোমোসোমের খাটো বাহুর DNA-এর শীর্ষে অবস্থিত।
২। উদ্ভিদের রোগপ্রতিরোধ বা প্রতিকূল পরিবেশে বেঁচে থাকার জন্য উপযোগী জিন অনুসন্ধান করা; যেমন- Bt toxin জিন CryIAC এবং লবণাক্ততা সহিষ্ণু জিন PDH. 45.
৩। উদ্ভিদের মান উন্নয়নের জন্য উন্নত বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন জিন অনুসন্ধান যেমন- গোল্ডেন রাইস এর বিটা-ক্যারোটিন জিন।
৪। উদ্ভিদ বা অণুজীবের মৌলিক গবেষণা কার্যকমে প্রয়োগ; যেমন— ধান, পাট, ভূট্টা ইত্যাদি ফসলের জিনোম সিকোয়েন্সিং তথ্য ।
৫। মানব জিনোম সিকোয়েন্সিং দ্বারা মানব জিনোমের অনেক তথ্যই এখন উন্মোচিত হয়েছে, যেমন— ইনস্যুলিন জিন-এর প্রয়োগ।
বিধানসমূহজীবপ্রযুক্তির উপকারী ভূমিকার মধ্যে রয়েছে-খাদ্য নিরাপত্তা বৃদ্ধি; খাদ্যের পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ বৃদ্ধিতে: চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন; খাদ্যাভ্যাসের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন ক্রনিক রোগের চিকিৎসা।
জীবপ্রযুক্তি একটি নতুন ক্ষেত্র এবং এ প্রযুক্তির মাধ্যমে উদ্ভাবিত জীবসমূহের (LMOs, Living Modified Organisms) পরিবেশের সাথে কী ধরনের আন্তঃক্রিয়া হতে পারে তা এখনও অজানা রয়ে গেছে। কেউ কেউ এ নতুন প্রযুক্তিতে উদ্ভাবিত জীবসমূহের জীববৈচিত্র্যে প্রতিকূল প্রভাব অথবা এর গ্রহণে মানব স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকির আশঙ্কা পরিবেশের উপর প্রতিকূল প্রভাব বিস্তার করতে পারে। আবার জীব প্রযুক্তি ব্যবহার করে যে সমস্ত ফসল উদ্ভাবন করা। করছেন। অনেক সময় ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গ দমনের জন্য যে জীবপ্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় তা উপকারী কীট-পতঙ্গ তথ্য হয় তার মধ্যে আগাছার বৈশিষ্ট্য প্রকট হয়ে যেতে পারে এবং তারা অন্যান্য প্রজাতির অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দেখা। দিতে পারে। আবার কোন জীবে নতুন জিন স্থানান্তরের মাধ্যমে যে প্রকরণ সৃষ্টি করা হয় সেই সমস্ত জিনের স্থায়ীত্ব খুব কম হতে পারে অথবা যে কোন সময়ে ঐ প্রকরণের নতুন জিনের সংযুক্তি ভেঙ্গে যেতে পারে।
জীবপ্রযুক্তির মাধ্যমে উদ্ভাবিত জীবে নিম্নলিখিত স্বাস্থ্য ঝুঁকি দেখা দিতে পারে : এলার্জি; বিষক্রিয়া: পুষ্টির ভারসাম্যহীনতা, খাদ্য বৈচিত্র্য হ্রাস।কৃষি, স্বাস্থ্য, জ্বালানী, পরিবেশ ইত্যাদি ক্ষেত্রে জীবপ্রযুক্তির অর্থনৈতিক সম্ভাবনা সর্বজন স্বীকৃত। কিন্তু সাথে সাথে GMOs (Genetically Modified Organisms) নিয়ে শঙ্কা রয়েছে যে মানবস্বাস্থ্য বা পরিবেশের উপর এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়তে পারে। GMOs-এর ক্ষেত্রে বিভিন্ন জীব থেকে জিনের যে সংমিশ্রণ ঘটানো হয় তা হয়ত প্ৰাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে। আরও শঙ্কা করা হচ্ছে যে ট্রান্সজেনিক জীবসমূহকে যদি মুক্তভাবে প্রকৃতিতে অবমুক্ত করা হয় তবে তা অনেক প্রাকৃতিক বা বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতি সমূহের জন্য ক্ষতিকারক হয়ে উঠতে পারে। এসব বিষয় বিবেচনা করে Convention on Biological Diversity এবং Cartagena Protocol অনুযায়ী বাংলাদেশে জীবপ্রযুক্তি প্রয়োগ বা কোন GMO অবমুক্ত করার ক্ষেত্রে কিছু বিধান করার সুপারিশ করা হয়।
জীব বৈচিত্র্যের সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবহার এবং পরিবেশের উপর কোন GMOs বা LMOs এর কী ধরনের প্রতিকূল প্রভাব থাকতে পারে তার ঝুঁকি নির্বাচন বা নির্ধারণ করতে হবে। Cartagena Protocol এর অনুচ্ছেদ ১৫ অনুযায়ী ঝুঁকি নির্ধারণে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হবে।
১. বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে এবং স্বচ্ছভাবে দক্ষ গবেষকের পরামর্শ অনুযায়ী এর সাথে সম্পর্কিত 'আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সাহায্য নিতে হবে।
২. জীবপ্রযুক্তি ব্যবহার করে যে সমস্ত GMOs/LMOs বা তাদের থেকে উদ্ভূত পণ্যের মধ্যে ঝুঁকি থাকার সম্ভাবনা আছে তা যদি কম ঝুঁকিপূর্ণ অন্য জীবের জেনেটিক উপাদান ব্যবহার করা সম্ভব হয় তা বিবেচনা করতে হবে।
৩. ঝুঁকি নির্ধারণ কেস বাই কেস করতে হবে। সংশ্লিষ্ট ঝুঁকি নির্ধারণে প্রয়োজনীয় তথ্য প্রকৃতি বা পরিবেশের অবস্থাভেদে ভিন্ন হতে পারে। অবস্থা অনুযায়ী ঝুঁকি নির্ধারণে সেগুলো বিবেচনা করতে হবে।